রচনা সংকেত: ভূমিকা ,ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ভাষা শহীদের আত্মদান ,মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ও আমাদের কর্তব্য, উপসংহার |
ভূমিকা:
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার বাঙালিরা স্বরূপ চেতনায় একটি পথ আবিষ্কার করেছিল। এই পথ দিয়েই পূর্ব বাংলার বাঙালি স্বাতন্ত্র নির্মাণ করেছে ও আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় বলিয়ান হয়েছে |
এদেশের আপামর জনসাধারণ নিজস্ব ভূখেরণ্ড জন্য যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছে,একুশের আন্দোলন সেই চেতনাকে ধারণ করবার সূচনা । শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নির্মোহ ,নিরাবেগ দেখবার ও প্রতিবাদের প্রেরণা । বাঙালির দেশচেতনারও আরম্ভ।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট :
১৯৪৭সালে ভারত -ভাগের পর পূর্ববাংলা বাংলাভাষী মানুষ নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানদের সংখ্যাই ছিল বেশি। তাই উর্দু ভাষাকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। প্রচারমাধ্যমে বিদ্যালয়গুলিতেও কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারে প্রস্তাব করা হয়। পূর্ববাংলার মানুষ এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি ওঠে ।কিন্তু পাকিস্তান সরকার শুধু যে এই প্রস্তাব খারিজ করে দেয় তা-ই নয়, মুদ্রা এবং ডাকটিকিট থেকেও বাংলা লিপি তুলে দেয়। পূর্বপাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা পরিষদ’। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে আন্দোলন এর কার্যক্রম আরো জোরদার হয়। দীর্ঘ চার বছর ধরে চলে আন্দোলন।
ভাষা শহীদের আত্মদান:
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে বলে রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ১৪৪ ধারা জারি করাই ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা,সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় । পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ফেব্রুয়ারি সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জুড়ো হয়ে১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে । আইনভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করলে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিবর্ষণে আত্মাহুতি দেন আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ,আব্দুস সালাম, আবুল বরকত প্রমুখ । ছাত্র আন্দোলন ক্রমে গণ আন্দোলনের রূপ নেয়।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামেও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয় । ১৯৬১ সালের ১৯মে আসামের শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন । পরবর্তীকালে আসামের তিনটি বাঙালি অধ্যুষিত জেলায় বাংলাকে আধা-সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয় ।
মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ও আমাদের কর্তব্য :
পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে পরিণত হয় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে । তারই ফলশ্রুতি হলো স্বাধীন বাংলাদেশে । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এত বড় আত্মত্যাগ আগে কখনো দেখা যায়নি। এই দিনটি স্মরণে রেখে আজও দুই বাংলা উৎসব পালন করে। গর্বের কথা, রাষ্ট্রসংঘও ২১ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে । এই দিনটি আমাদের স্মরণ করায় এক অখণ্ড বাঙালিসত্ত্বার কথা ।
তাই ২১ ফেব্রুয়ারির শপথ আমাদের মাতৃভাষাকে আরো অনেক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আর তা করতে হলে মাতৃভাষাচর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া , নিরক্ষর বাঙালি কে আপন ভাষায় স্বাক্ষর করে তোলার আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করা প্রয়োজন ।১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে অজস্র কবিতা ছোটগল্প ,উপন্যাস ,নাটক ,বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ ,স্মৃতিকথা ,গবেষণা গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে ।আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলতে পারি ‘ গানটি বাঙালির চিরন্তন আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ভাষা শহীদদের স্মরণে নানা দেশে বেদি নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটিতে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়ে থাকে।
উপসংহার :
আমাদের সচেতন থাকতে হবে, ভাষা ও ভাষাশহীদদের প্রতি আবেগ যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয় । তা যেন একটি বিশেষ দিনে সীমাবদ্ধ না থাকে । আজ মিশ্র সংস্কৃতির আগ্রাসনে বিপন্ন আমাদের মাতৃভাষা । তার মর্যাদা বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে । অন্য ভাষার প্রতি সহনশীলতা বা শ্রদ্ধা না হারিয়েও মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সদা সচেষ্ট থাকতে হবে । একুশে ফেব্রুয়ারি সেই শপথের দিন।